21 June 2010

একজন হাজারী, কয়েকটি বাঘ এবং কিছু কথা

গত ২৮ মে, ২০১০ (শুক্রবার) “দৈনিক আমাদের সময়” পত্রিকায় জয়নাল হাজারীর একটি লেখা ছাপানো হয় যার শিরোনাম ছিল “বাঘ রক্ষা নয়, ধ্বংস করব”। শিরোনামে প্রবন্ধটির যে সারমর্ম প্রকাশ পাচ্ছে, প্রবন্ধের ভেতরে ঠিক সে ভাবটিই প্রকাশ করেছেন জনাব জয়নাল হাজারী। প্রবন্ধের কিছুটা অংশ তুলে ধরলামঃ-

“.................... বাঘ সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী হরিণ খায়, মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রাণী গরু, মহিষ, ছাগলসহ সবই মেরে খেয়ে ফেলে। .................... বাঁচিয়ে রেখে নয়, বরং সব বাঘ মেরে ফেলে ওদের চামড়া দিয়ে জুতা তেরি করা হোক। ওদের চামড়া ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা হোক। ....................আমি বাঘ রক্ষার বিরুদ্ধে শুধু সাধারণ অবস্থান নয়, এর বিরুদ্ধে সর্বত্র আন্দোলন গড়ে তুলব।”

বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে যে বাঘরক্ষা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে এবং বিশ্ব ব্যাংক তাতে অর্থ সহায়তা দেবে এই প্রেক্ষিতে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়।

প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি যে, প্রাবন্ধিকের সাংঘাতিক নির্বুদ্ধিতা, ঘোরতর অজ্ঞতা, অসচেতনা, এবং আমাদের দেশের এক অন্ধকার ভবিষ্যতের উজ্জল নিদের্শক তা যে কোন স্বল্পশিক্ষিত (হয়ত, অশিক্ষিত) ব্যক্তিরও বোঝার কথা, বর্তমানে ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণীর যে কোন ছাত্রছাত্রী খুব পরিস্কারভাবে এটা জানে যে, পরিবেশের প্রতিটি প্রাণীর, প্রতিটি উদ্ভিদের প্রতিটি প্রজাতি একটি বৃহৎ খাদ্য শৃঙ্খল (Food Chain) এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই খাদ্য শৃঙ্খল প্রতিটি জীবের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন একটি প্রজাতির বিলোপসাধনে ঐ অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য অনেক পরিবর্তন আনবে যার দ্বারা ঐ অঞ্চলের মনুষ্য সম্প্রদায়ের ক্ষতিও হবে ব্যাপক, এমনকি ঐ অঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হওয়া মোটেও বিচিত্র নয়। হরিণ আছে বলেই বাঘ আছে, বাঘের অনুপস্থিতিতে সুন্দরবনে হরিণ এবং তৎসংশ্লিষ্ট প্রাণীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে যা সুন্দরবনের গোটা বাস্তুতন্ত্রকেই বিপর্যয় করে তুলবে। মনুষ্যসৃষ্ঠ বিভিন্ন কারণে যখন বনাঞ্চলে বাঘ তার খাদ্য আহরণে ব্যর্থ হয় কেবল তখনই বাঘ লোকালয়ে আসতে বাধ্য। অর্থাৎ বাঘের লোকালয়ে আগমনের পেছনে মূল প্রভাবক মানুষ। ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ অথবা অন্য কোন শক্তি যা খাদ্য শৃঙ্খল নষ্ট করছে। বংলাদেশে মূলত শেষোক্ত কারণটিই বেশি সক্রিয়। বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সরকারের উদাসীনতাও অনেক বড় কারণ। এটি আরও বড় সত্য যে, যেসব বাঘ খাদ্য অন্বেষণে লোকালয়ে এসে পড়ে, তাদের অনেকেরই আর বনে ফেরা হয় না। পরদিন পত্রিকার শেষ পাতায় কোন এক অঞ্চলে গ্রামবাসীর হাতে কোন এক বাঘের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। হয়ত জয়নাল হাজারীদের ইচ্ছা পূরণে সেই হতভাগ্য বাঘদের চামড়া তাদের বৈচিত্র্যখানার দেয়ালে ঝোলানো হয়, যা পক্ষান্তরে সে গৃহস্থের রুচিহীনতার এক উজ্জ্বল প্রমান। লক্ষ কোটি প্রজাতির বাসস্থান এই পৃথিবীর জন্য হুমকি যদি কোন প্রজাতি হয়ে থাকে তবে তা মানুষ। (নিন্দুকেরা বলে থাকে, এই প্রজাতিটির কিছু সদস্যকে পৃথিবী থেকে বিলোপ সাধনে প্রাবন্ধিকের একটি বড় ভূমিকা আছে।)

বলবার অপেক্ষা রাখে না যে,“আমাদের সময়” দেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা এবং জনাব জয়নাল হাজারীও এদেশে অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ব, তার কারণ যাই হোক। একটি দেশের এত প্রচারিত একটি দৈনিকে যখন এতটা উদ্ভট, হাস্যকর প্রবন্ধ ছাপায় তখন তা শুধু ঐ পত্রিকা বা প্রাবন্ধিকের নয়, বরং পুরো দেশের মনস্কতা ও বিজ্ঞানচর্চার প্রতি একটা মানহানীকর বিদ্রুপ করে। ব্যক্তিগতভাবে অমি মনে করি,“ আমাদের সময়” কর্তৃপক্ষ সেটা জানেন।

বর্তমান বিশ্বে আর দশটা প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো “তথ্য” একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। এবং দেশের পুরো মিডিয়া (সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ইত্যাদি) বিভিন্নভাবে তা জনগণের কাছে উপস্থাপন করে। তথ্য পেয়ে যেখানে মানুষের সচেতন হবার কথা, সেখানে তা না হয়ে সম্পূর্ণ উল্টোটাই হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের নূন্যতম জ্ঞান ছাড়াই একজন জয়নাল হাজারী “দৈনিক হাজারিকা” ও “সাপ্তাহিক হাজারিকা” নামের দুটি পত্রিকার সম্পাদক পদে নিজেকে অধিষ্ঠত করেন। কেবল অর্থ ও ক্ষমতার জোরে শেষোক্ত পত্রিকাটি “দৈনিক আমাদের সময়” এর সাথে সপ্তাহে একদিন দেয়া হয়। সেই পত্রিকার সংবাদ ও সংবাদ লেখবার কায়দা কানুনও অনেকটাই অদ্ভুদ। তবে কি আমরা, পাঠকরা, ধরে নেব “আমাদের সময়” এর কোন ফান ম্যাগাজিন নেই বলে, এটি তারই বিকল্প ? যদি তাই হয়, তবে পাঠকের কাছে সে সত্য প্রকাশ করা উচিৎ, কেন মিছেমিছি আমরা বিভ্রান্ত হব?

জনাব জয়নাল হাজারী এমন কেন করেছেন জানি না, হয়ত বাঘের প্রতি যুক্তিহীন ক্রোধের বর্শবর্তী হয়ে, অথবা নিজেকে কোন ভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করে আলোচনার কেন্দ্রে আসতে। যদি কারণ প্রথমটি হয়, তবে শুনুন অতীত ও সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে বিশ্ব ব্যংকের অর্থায়নে তৃতীয় বিশ্বের প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগের পরিণিতিই বড় নির্মম। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবার হলে আপনার চক্ষুশূল বাঘদের সংখ্যাবৃদ্ধি নয়, বরং উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবার কথা। আর যদি যে কোনভাবে হোক সবার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করা তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে পত্রিকা সম্পাদকের এ সুযোগ দেয়া উচিৎ হয়নি। পাঠকের প্রতি এ বড় অবিচার।

এটা নিশ্চিত যে, একদিন জনগণ সচেতন হবেই, নিজের সঠিক তথ্যের অধিকার তারা নিশ্চিত করবে, যেদিন এদেশে পরিকল্পিত কোন তথ্য বিভ্রান্তি থাকবে না, থাকবে না পরিবেশে ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার নামে সাম্রাজ্যবাদী শঠতা। দেশ আবার হয়ে উঠবে ধনধান্য পুষ্পেভরা এবং নানা প্রজাতির মিলনমেলা। হয়ত সেদিনের আর বেশি দেরি নেই।


মাহির দায়ান আমিন
অনুসন্ধিৎসু চক্র, মিরপুর শাখা

4 comments:

dub said...

এইটা একটা চরম হাস্যকর খবর। জনাব হাজারীকে নিয়ে তো কিছুই বলার নেই। আমাদের সময় পত্রিকা সম্ভবত লেখায় বক্তব্য কিংবা বস্তুনিষ্ঠতার বদলে লেখক তোষণ নীতি অনুসরণ করছেন। এই পোস্টটা শেয়ার করলাম।

Anonymous said...

মাহীর দায়ান আমিন,
আপনার লেখনী চমৎকার। নিয়মিত লিখার চর্চা চালিয়ে যান। তবে জয়নাল হাজারীর মতো নিকৃষ্ট আবর্জনাকে স্পর্শ না করলেও আমাদের চলবে। কারণ তার চেয়ে অনেক বড়ো বড়ো মুখোশধারী বদমাশ চারপাশে ছড়িয়ে আছে যাদের প্রভাবের কাছে হাজারীর মতো দশবিশটা অপগন্ড কিছুই না। আরেকটি কথা ভাষাগত ক্ষেত্রে আরো সংযত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

EK LOTAN said...

হাজারী ওনি হচ্ছেন গিয়ে ৭ম স্তরের বুদ্ধিহীন মানব।তেনার আদিপুরুষ রাম ছাগলের সাথে বাস করতেন।
অচিরেই এনাদের মত মানবের বিলুপ্তি ঘটুক।তাদের ফরমালিন দিয়ে জাদুঘরে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।আমীন।।।
এমন ছাগলদের বিলুপ্তিতে বাস্তু সংস্থানের পরিবর্তন ঘটে না।

Unknown said...

টাকা ও ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে একজন বুদ্ধিজীবি হওয়া যায় তিনি তার সত্যিকারের প্রমাণ। শুধু আমার দেশ কেন তার নিজের একটি দৈনিক পত্রিকা আছে ‍" হাজারিকা প্রতিদিন" এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্টমন্ত্রী উনাকে ফেরেশতা মনে করেন। বলুন "সুবাহাল্নাহ"