14 August 2010

মেছো বাঘ

মেছো বাঘ, স্থানীয়ভাবে এর নাম গো-বাঘা। একসময় দেশজুড়েই ছিল এদের বিচরণ। তবে এখন প্রাকৃতিক বন বাদে অন্যত্র মেছো বাঘ মহা বিপন্ন।
ইংরেজি নাম Fishing cat. বৈজ্ঞানিক নাম Felis viverrina. লেজ বাদে শরীরের মাপ ৭০-৮০ সেন্টিমিটার। লেজের মাপ ৬০-৬৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১২-১৫ কেজি।

13 August 2010

প্রাণবৈচিত্র্য (Biodiversity)

কেমন হতো, যদি সারা পৃথিবী জুড়ে থাকতো কেবল এক ধরনের গাছ, সাগরে মহাসাগরে এক ধরনের মাছ, বনভূমি জুড়ে এক ধরনের প্রাণী বা আকাশে উড়ে বেড়াতো কেবল এক ধরনের পাখি? এই পৃথিবী কি তখন এতো ভাল লাগতো আমাদের? কেবল ভাল লাগাই নয়। বেঁচে থাকাও কি তখন সহজ হতো? সব খাবার কি একই গাছ বা মাছ থেকে পাওয়া যেতো? খাবার যোগানের গাছগুলোই কি টিকতে পারতো কেবলই যন্ত্রের মত একই ধরনের চারপাশের ওপর নির্ভর করে? কোনোটাই হতো না। বিচিত্র গাছ, বিচিত্র প্রাণী, বিভিন্ন এলাকায় বিচিত্র পরিবেশ আছে বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর, রঙিন, বৈচিত্র্যময়! আর, এতো সম্ভবনা !


উন্নয়ন ও প্রাণবৈচিত্র্য

প্রচলিত ধারার উন্নয়ন ভাবনায়, পরিবেশের কথা কম ভাবা হয়। আমাদেরকে শেখানো হয়, প্রকৃতির ওপর নির্ভর করাটা পশ্চাৎপদতার লক্ষ্মণ। আধুনিক কৃষি বলতে আমাদের সামনে যে চিত্র তুলে ধরা হয়, তা হলো, গবেষণাগারে তৈরি বীজ, রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে, পাম্প দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে কৃত্রিম সেচ দিয়ে ফসল উৎপাদন।


প্রাণবৈচিত্র্য কেন হুমকির সম্মুখীন ?

পৃথিবীর বিভিন্ন উদ্ভিদ, প্রাণী, অনুজীব ও তাদের চারপাশের পরিবেশ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল; তাই প্রাণবৈচিত্র্যের যে কোন একটি প্রজাতির বা পরিবেশের বিলুপ্তির সাথে সাথে ঐ প্রজাতি/পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্যান্য প্রাণও বিলীন হয়ে যায়।উদাহরণস্বরূপ, কোন এলাকার সমস্ত বট গাছ যদি কেটে ফেলা হয়, তাহলে ঐ বট গাছগুলো যেসমস্ত বাদুড়, চিল, শকুন, কাঠবিড়ালী, গেছো ব্যাঙ ও অন্যান্য প্রাণীকে খাদ্য বা আশ্রয় যোগাতো, তারাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে, যদি কোন প্রজাতির পোকা বা পাখি বিলুপ্ত হয়, তাহলে তারা যেসমস্ত উদ্ভিদের পরাগায়ন বা বীজের বিস্তার ঘটাতো, অথবা তাদেরকে খেয়ে যেসব প্রাণী বাঁচতো, সেসব উদ্ভিদ ও প্রাণী-ও বিপন্ন হয়। আবার কোন বন ধবংস হলে বা কোন জলাশয় দূষিত বা ভরাট হয়ে গেলে ঐ বন বা জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী-ই বিলুপ্ত বা বিপন্ন হয়।

বিভিন্ন প্রাণীর আবাসভূমি ধ্বংস, আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভব, দূষণ এবং ‘‘পরিবেশ-বিমুখ’’ কৃষিকাজের দরুন পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য খাদ্য যোগানোর নামে “সবুজ বিপ্লব” বিভিন্ন দেশে স্থানীয় বহু জাতের ধানকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে; যদিও পৃথিবীতে আজও ১০০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত। বিগত ৫০ বছরে ভারতের কৃষকেরা ৩০,০০০ জাতের ধানের চাষ করতেন। অথচ “সবুজ বিপ্লব” প্রবর্তনের ১৫ বছরের মাথায় দেখা গেল, ভারতের মোট ধান উৎপাদনের ৭৫%-ই আসছে ১০টি জাতের তথাকথিত উচ্চফলনশীল (উফশী) ধান থেকে। “সবুজ বিপ্লব”-এর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রাসায়নিক কীটনাশক। বাংলাদেশে এর ফল মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২৮ মার্চ ২০১০ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো-তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজশাহীর বাগমারায় ক্ষেতে মৌমাছি না আসায় পেঁয়াজের পরাগায়ন হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে চাষীরা মৌমাছি ভাড়া করে আনছেন। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলিম উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, “নির্বিচারে কীটনাশক ছিটানোর কারণেই উপকারী মাছিগুলো মারা যাচ্ছে আর ক্ষতিকারক মাছিগুলোর টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়ছে।”

শিল্প কারখানার দূষণ বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। শিল্প কারখানার মালিকেরা আইন অমান্য করে শিল্প কারখানার বর্জ্য নির্বিচারে খাল-বিল-নদী-সমুদ্রে ফেলছেন। ফলে মারা যাচ্ছে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী, সেই সাথে জলজ উদ্ভিদ। বর্তমানে বাংলাদেশের ৫৪ প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে আছে। শিল্প কারখানার দূষণ ও কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার-কীটনাশকের ব্যবহার এর অন্যতম প্রধান কারণ।

মুনাফার জন্য, রকমারি ভোগ্যপণ্য দিয়ে জীবনকে সাজানোর জন্য শিল্প কারখানা স্থাপন করতে গিয়ে পৃথিবীব্যাপী বন ধবংস করা হচ্ছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনের অর্ধেকই ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ আমাদের সবারই, বিশেষত আমরা যারা বেশি ভোগ করার সুযোগ পাই, তাদের ভেবে দেখা উচিত - কোন কোন পণ্যগুলো ব্যবহার না করলেও চলে।

বিদেশী গাছ: কেন লাগানো উচিত নয়?

কোন এলাকায় কী ধরনের গাছ জন্মাবে তা নির্ভর করে সে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন অজৈব উপাদান যেমন - মাটি, পানি, জলবায়ু ইত্যাদির ওপর। আর, কোন এলাকায় কী ধরনের প্রাণী বাস করবে তা নির্ভর করে সেখানকার পরিবেশের অজৈব উপাদান ও সেই সাথে সেখানকার উদ্ভিদের ওপর। এ কারণেই বিদেশী গাছ দেশী প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য সহায়ক নয়। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার ইউক্যালিপটাস গাছ অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীকূলের (কীটপতঙ্গ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর) জন্য উপযুক্ত; কিন্তু বাংলাদেশের প্রাণীকূলকে তা খাদ্য ও আশ্রয় যোগাতে পারে না। তাই দেশী গাছের বদলে বিদেশী গাছ দিয়ে কোন এলাকা ছেয়ে ফেললে, সে এলাকার প্রাণীকূলের খাদ্যের উৎস ও আবাস ধ্বংস হয়, পরিণামে তারা সেখান থেকে বিলুপ্ত হয়। এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করে, সামপ্রতিক কালে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বনায়নের নামে বিভিন্ন বিদেশী গাছ, যেমন - ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া, মেহগনি, শিশু ইত্যাদি লাগানো হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য ব্যাপক হ্রাসের এটিও অন্যতম কারণ। বনায়নের নামে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের এ ধরনের উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।

আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ ২০১০

পৃথিবীর ২০০টি দেশের প্রতিনিধি ২০০২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২০১০ সালকে ‘‘আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ’’ হিসেবে ঘোষণা করেন। সভায় লক্ষ্য স্থির করা হয়, ২০১০ সাল পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এ বছর অক্টোবর মাসে প্রাণবৈচিত্র্য সনদের একটি আন্তর্জাতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে জাপানে। এ ক্ষেত্রে উন্নতি কতোটা হয়েছে, লক্ষ্য পূরণে কতোটা সফল হওয়া গেছে, তা এই বৈঠকে পরিমাপ করা হবে। জাতিসংঘের মতে, প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ পালনের যে সারকথা দুনিয়ার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, তা হলো:

১. মানুষ ও পরিবেশের মান রক্ষায় প্রাণবৈচিত্র্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২. বর্তমান বিশ্বে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের মাত্রা আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই
অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।
৩. অনেক সাফল্যের উদাহরণ আছে। তাই সাথে করে এগিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য

আমাদের বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক জনপদ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এপ্রিল ২০০৯ বুলেটিনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের নদী অঞ্চলের আয়তন ৮২৩৬ বর্গ কিলোমিটার (মোট আয়তনের ৭.৫%) ও বনাঞ্চলের আয়তন ১৯৭০ বর্গ কিলোমিটার (মোট আয়তনের ১৮%)। অবশ্য বেসরকারী পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশের বনভূমি মোট আয়তনের ৮-৯% বা আরও কম। আইইউসিএন ২০০২ সালে বাংলাদেশকে ২৫টি জৈব-বাস্তুসংস্থান এলাকায় ভাগ করেছে। জানুয়ারি ২০১০-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের Forth National Report to the Convention on Biological Diversity - এ বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৭০ প্রজাতির ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়া, ১৯৮৮-রও অধিক প্রজাতির শৈবাল, ২৭৫ প্রজাতির ছত্রাক, ২৪৮ প্রজাতির ব্রায়োফাইট (মস এর অন্তর্গত), ১৯৫ প্রজাতির টেরিডোফাইট (ফার্ন এর অন্তর্গত), ৭ প্রজাতির নগ্নবীজী উদ্ভিদ ও ৩৬১১ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ চিহ্নিত করা গেছে উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৬৫০ প্রজাতির পাখি, ১৫৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৪ প্রজাতির উভচর, ৬৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছ এবং ৬২০০-র অধিক প্রজাতির অমেরুদন্ডী প্রাণী রয়েছে। বাংলাদেশের মত ছোট একটি দেশে এতো প্রজাতির উপস্থিতি-ই বলে দেয়, প্রাকৃতিক সম্পদে তা কতোটা সমৃদ্ধ! কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রজাতিই সংখ্যার দিক থেকে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

চিরচেনা প্রাণীগুলো কি হারিয়ে যাবে ?

বাংলাদেশ থেকে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩০ প্রজাতির পাখি ও ১ প্রজাতির সরীসৃপ। আমাদের ভূখন্ড থেকে হারিয়ে গেছে গন্ডার, বুনো মোষ, নীলগাই, ডিম-খেকো সাপ, গোলাপী শির হাঁস, কালো হাঁস, রাজশকুন ইত্যাদি। বর্তমানে হুমকির মুখে আছে ৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪১ প্রজাতির পাখি, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৫৪ প্রজাতির মাছ



পরিবারপ্রাণী
স্তন্যপায়ীরয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, এশিয়ান হাতি, উল্লুক, খেঁকশিয়াল, বনবিড়াল, শুশুক, বড় বেজি, খাটাস, বাঘডাস, শজারু
পাখিকোকিল, হুতুম পেঁচা, লাল মাছরাঙা, রাজধনেশ, পাহাড়ি নীলকন্ঠ, পাহাড়ি ঘুঘু, হরিয়াল, রঙিলা বক, হাড়গিলা
সরীসৃপলোনা পানির কুমির, গোলবাহার অজগর, ঘড়িয়াল, বোস্তামী কাছিম, তক্ষক,রক্তচোষা, সোনা গুইল, লাউডগা সাপ, কালনাগিনী সাপ, রাজগোখরা সাপ, চন্দ্রবোড়া সাপ, লাল ঢোঁড়া সাপ
উভচরপটকা ব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ, পানা ব্যাঙ, লাল চীনা ব্যাঙ
মাছচিতল, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, টেংরা, গাঙ মাগুর, ফলি, তারা বাইন, কালিবাউস, আইড়


এই চিরচেনা প্রাণীগুলোকে কি হারিয়ে যেতে দিবো আমরা ?