13 August 2010

প্রাণবৈচিত্র্য (Biodiversity)

কেমন হতো, যদি সারা পৃথিবী জুড়ে থাকতো কেবল এক ধরনের গাছ, সাগরে মহাসাগরে এক ধরনের মাছ, বনভূমি জুড়ে এক ধরনের প্রাণী বা আকাশে উড়ে বেড়াতো কেবল এক ধরনের পাখি? এই পৃথিবী কি তখন এতো ভাল লাগতো আমাদের? কেবল ভাল লাগাই নয়। বেঁচে থাকাও কি তখন সহজ হতো? সব খাবার কি একই গাছ বা মাছ থেকে পাওয়া যেতো? খাবার যোগানের গাছগুলোই কি টিকতে পারতো কেবলই যন্ত্রের মত একই ধরনের চারপাশের ওপর নির্ভর করে? কোনোটাই হতো না। বিচিত্র গাছ, বিচিত্র প্রাণী, বিভিন্ন এলাকায় বিচিত্র পরিবেশ আছে বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর, রঙিন, বৈচিত্র্যময়! আর, এতো সম্ভবনা !



এই প্রাণবৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগের বেশি প্রজাতির প্রাণী হুমকির মুখে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দি কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০০৪ সালে হুমকির মুখে রয়েছে এমন প্রজাতির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৩ শতাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১২ শতাংশ পাখি, ৩২ শতাংশ উভচর প্রাণী, ৬১ শতাংশ সরীসৃপ, ৪৬ শতাংশ মাছ ও ৭০ শতাংশ উদ্ভিদ (মস, ফার্ন ইত্যাদি সহ) হুমকির সম্মুখীন। শীর্ষস্থানীয় প্রাণীবিজ্ঞানী এডোয়ার্ড ও উইলসনের দেয়া হিসেব অনুসারে বছরে ২৭ হাজার প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। এর অর্থ, পৃথিবীর বুক থেকে প্রতি ঘন্টায় হারিয়ে যাচ্ছে ৩টি প্রজাতি। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের ২০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এমন-ই এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ ২০১০ সালকে ‘‘প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ’’ ঘোষণা করেছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “প্রাণবৈচিত্র্যই আমাদের জীবন”।

প্রাণবৈচিত্র্য (Biodiversity) কি?

সকল উদ্ভিদ, প্রাণী, অনুজীব ও জড়বস্তু (মাটি, পানি, বায়ু ইত্যাদি); তাদের মধ্যে বিরাজমান সকল দেখা ও না-দেখা বা সহজে দেখা যায় না, এমন জৈবিক প্রক্রিয়া; এবং তাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে বলে প্রাণবৈচিত্র্য। খুব সহজভাবে বলতে গেলে, প্রাণবৈচিত্র্য হচ্ছে প্রজাতির বৈচিত্র্য এবং প্রজাতির আধিক্য। জীববিদরা প্রাণবৈচিত্র্যকে বর্ণনা করেন এভাবে: প্রাণবৈচিত্র্য হচ্ছে একটি এলাকার জিন ও প্রজাতির সমষ্টি এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া। বিজ্ঞানীদের মতে প্রাণবৈচিত্র্যকে তিন স্তরে ভাগ করা যায়: জিনগত বৈচিত্র্য, প্রজাতিগত বৈচিত্র্য এবং প্রাণ ও জড়বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়াগত বৈচিত্র্য। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ক্যাম্পবেল প্রাণবৈচিত্র্যের চতুর্থ আরেকটি স্তরের কথা বলেছেন। তা হচ্ছে, আণবিক বৈচিত্র্য।

প্রাণবৈচিত্র্যই আমাদের জীবন

মানব জীবনে প্রাণবৈচিত্র্যের ভূমিকা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ? পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন অবান্তর শোনায়। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের আবির্ভাব কিছুকাল আগে। তার পূর্বে কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে মানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ; সৃষ্টি হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী, অনুজীব। মানুষের ও সভ্যতার গড়ে ওঠার পেছনে এসমস্ত প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অথচ, সেই মানুষ-ই আজ নিজের নির্বিচার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার হাজার প্রজাতিকে বিপন্ন করছে, সেই সাথে বিপন্ন করছে নিজের অস্তিত্বও। লক্ষ কোটি বছর ধরে গড়ে উঠেছে যে বনভূমি, তা মানুষ কেটে ফেলছে নিমেষে; মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে যে কেঁচো, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে তাকে বিপন্ন করছে; ক্ষতিকর প্রাণী, পোকা খেয়ে ফসল বাঁচায় যে পেঁচা, গাছ কেটে তার আবাস ধংস করছে।

আমাদের জীবনে প্রাণবৈচিত্র্যের ভূমিকা যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই সচেতন নই। প্রাণবৈচিত্র্য আমাদের চারপাশে প্রাণ টিকে থাকার প্রক্রিয়াকে সচল রাখে। কার্বন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র - এসব প্রাকৃতিক চক্রের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য আমাদের মাটিকে উর্বর রাখে, বাতাস ও আবহাওয়াকে আমাদের বসবাসের উপযোগী করে। রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ ও পানি বিশুদ্ধকরণে প্রাণবৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। খাদ্যের জন্য আমরা তিন হাজারের বেশি প্রজাতির উদ্ভিদের আবাদ করি। এসব উদ্ভিদে পরাগায়ন ঘটাতে, ফুল-ফল-ফসল জন্মাতে সাহায্য করে আরও হাজার রকমের পতঙ্গ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী। বিরাট সব শিল্প-কারখানায় প্রয়োজনীয় হাজার রকমের পণ্য তৈরি করছি আমরা। এগুলোর কাঁচামালের উৎসও প্রাণবৈচিত্র্য। রোগ নিরাময়, নিত্য নতুন ঔষধ আবিষ্কার ও তৈরির জন্য আমরা প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা - বৈচিত্র্যহীন পৃথিবীতে এসব সম্ভব কি? বিচিত্র সব উদ্ভিদ-প্রাণী-বন-প্রান্তর-নদী বেষ্টিত নিসর্গ আমাদেরকে যে প্রশান্তি এনে দেয়, তা কি অমূল্য নয়?

পৃথিবীর বিপুল প্রাণসম্ভার সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? বিশ্বের ৩ কোটি প্রজাতির মধ্যে মাত্র ১৪ লাখ প্রজাতিকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা গেছে। যেগুলোকে চিহ্নিত করা গেছে, সেগুলো সম্পর্কেই কি আমরা সবটুকু জানি? প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে জন্মানো ‘প্যাসিফিক ইউ’ গাছকে এতদিন মনে করা হতো ‘আগাছা’। আজ জানা গেছে, এতে আছে ক্যান্সারের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় উপাদান। তাই, আমাদের জানা-অজানা লাখ লাখ বিপন্ন প্রজাতিকে যদি আমরা হারিয়ে যেতে দেই, তাহলে আমরা হয়ত কোনদিনই জানতে পারবো না - কী অমূল্য জ্ঞান, কী অমূল্য সম্পদরাজি আমরা হারিয়েছি !

No comments: